উখিয়া নিউজ ডেস্ক
প্রকাশিত: ০১/০৯/২০২২ ৯:৫৩ এএম

মিয়ানমার সম্প্রতি বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে সীমান্তে দুটি মর্টার শেল নিক্ষেপ করেছে। মিয়ানমারের দিক থেকে আকাশসীমা লঙ্ঘন অবশ্য নতুন কিছু নয়। শুধু বাংলাদেশ নয়; এর আগে চীন ও থাইল্যান্ডের আকাশসীমাও লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। বস্তুত এসব ঘটনা দেশটির বেপরোয়া আচরণেরই বহিঃপ্রকাশ। আমরা জানি, দেশটিতে চলছে সামরিক শাসন। মাঝে এক ধরনের ‘সীমিত’ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমরা দেখেছি। তারও আগে ৫৫ বছর একটানা সামরিক শাসনে ছিল দেশটি। ফলে আন্তর্জাতিক বিশ্ব থেকে বহুলাংশে বিচ্ছিন্ন দেশটি আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্বাভাবিক নিয়ম-কানুন, রীতিনীতি মেনে চলার ক্ষেত্রে বরাবরই নেতিবাচক অবস্থান গ্রহণ করে থাকে।
আমরা দেখেছি, সামরিক জান্তার স্বার্থে আন্তর্জাতিক বিশ্বের সঙ্গে মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতা দেশটির নাগরিকরাও ইতিবাচকভাবে নেয়নি। ২০২১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি সেখানে সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই প্রতিবাদী মানুষ বাইরে নেমে আসে। প্রতিবাদকারীদের হত্যা, দমন-পীড়নের পরও তাদের আন্দোলন থেমে নেই। মিয়ানমারের নানা সংখ্যালঘু গোষ্ঠীও আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে সেখানকার সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘুদের ওপর হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণ, সহিংসতা ও নিপীড়ন চালিয়েছে। রোহিঙ্গাদের ভূমি রাখাইন রাজ্যের স্থানীয় সশস্ত্র সংগঠন আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর সংঘর্ষের জের ধরে বাংলাদেশ সীমান্তের অভ্যন্তরে মর্টার শেল পড়ে। স্থানীয় প্রশাসন এবং ওই এলাকার বাসিন্দাদের বরাতে সংবাদমাধ্যমে এসেছে, দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সীমান্তের ওপারে রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। দু’পক্ষের মধ্যে তুমুল লড়াইয়ে সীমান্তে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার ও যুদ্ধবিমানের তৎপরতাও দৃশ্যমান।
২০১৭ সালের রোহিঙ্গা সংকটের পর থেকে কয়েকবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। এবারের ঘটনার আগে ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলার আলীকদম সীমান্তে মিয়ানমারের একটি হেলিকপ্টার বাংলাদেশের অন্তত ২ কিলোমিটার অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশ করেছিল। তারও আগে ২০১৭ সালে বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্ত দিয়ে দু’বার মিয়ানমারের হেলিকপ্টার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল। অবশ্য প্রতিবারই বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কড়া প্রতিবাদ জানানো হয়েছিল। আমরা জানি, সীমান্তের ৮ কিলোমিটারের মধ্যে সেনাবাহিনীর যে কোনো কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন। কিন্তু তা না মেনে উল্টো বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বারবার ঢুকে পড়ে তারা।
এবারের ২৮ আগস্টের মর্টার শেল দুটি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের তুমব্রু বাজার এলাকায় পড়ে। যেখানে মর্টার শেল দুটি পড়ে সেখানে অনেকেই হতাহত হতে পারত। তবে সেগুলো বিস্ম্ফোরিত হয়নি। আমাদের মনে আছে, ২০১৫ সালে যখন মিয়ানমারের যুদ্ধবিমান চীনে ঢুকে পড়ে, তখন চারজন কৃষক নিহত হয়। সে ঘটনায় চীন ব্যাপক প্রতিবাদ জানায়। মিয়ানমার তাতে চীনের কাছে দুঃখ প্রকাশ করে। থাইল্যান্ডের আকাশসীমাও কয়েকবার লঙ্ঘন করেছে মিয়ানমার। মিয়ানমারের কারেন সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন নামে সশস্ত্র সংগঠন থাইল্যান্ড সীমান্তের কাছে শক্তিশালী ঘাঁটি গাড়ে। তাদের সঙ্গে সংঘর্ষের জেরেই থাইল্যান্ডে বারবার মিয়ানমার আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। থাইল্যান্ড কিংবা চীনের সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক কারণে মিয়ানমারের এক ধরনের ‘ভালো’ সম্পর্ক আমরা দেখি। তারপরও আকাশসীমা লঙ্ঘনের মতো ঘটনায় তারা তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে। সর্বশেষ ৩০ জুন যখন থাইল্যান্ডের আকাশসীমায় যুদ্ধবিমান মিগ-২৯ জেট ঢুকে পড়ে, তখনও থাইল্যান্ড তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং মিয়ানমার সেজন্য দুঃখ প্রকাশ করে।

মিয়ানমারের যুদ্ধবিমানের অন্য দেশে ঢুকে পড়া কিংবা অন্য দেশের আকাশসীমা লঙ্ঘনের ঘটনা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠীর সঙ্গে সংঘাতের কারণে ঘটছে। এবার বাংলদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন কিংবা মর্টার শেল নিক্ষেপের ঘটনাও এর বাইরে নয়। এবার আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষের বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী আগামী বছর একটি বৈধতার নির্বাচনের ছক কষছে বলে আমরা জানি। ওই নির্বাচনে রাখাইন রাজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাখাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়েই বস্তুত আরাকান আর্মির সঙ্গে সংঘর্ষে জড়াচ্ছে মিয়ানমার সামরিক জান্তা।
সীমান্ত পরিস্থিতি হয়তো কখনও কখনও নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে। কিন্তু মিয়ানমারের ক্ষেত্রে তা যেভাবে নিয়মিতভাবে ঘটছে, সেটাই প্রমাণ করছে, দেশটির সামরিক বাহিনী কতটা বেপরোয়া। যদিও তারা ভেতরে-বাইরে উভয় দিক থেকেই চাপের মধ্যে রয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের সামরিক নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে; রোহিঙ্গা গণহত্যার কারণে আন্তর্জাতিক আদালত থেকে শুরু করে বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে রয়েছে; গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মিয়ানমারে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছে, তা এখনও চলমান। বিভিন্ন নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর সঙ্গে নিয়মিত সংঘাত ছাড়াও সামরিক শাসনের বাইরে মিয়ানমারের যে ঐক্য সরকার গঠিত হয়েছে, সে ঐক্য সরকারও দেশের মানুষ এবং বাইরের সমর্থন নিয়ে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলছে এবং সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। এত চাপের মধ্যেও মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বেপরোয়া মনোভাবের পেছনে চীন ও রাশিয়ার সমর্থন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাইওয়ান সংকট এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করে তারা আমাদের উস্কানি দিতে চায়, যাতে আমরাও সামরিক দিক থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি। বাংলাদেশ যদি মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক যুদ্ধে লিপ্ত হয়, তাতে মিয়ানমারেরই লাভ। তারা এ ইস্যুটি ব্যবহার করে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের পথ আটকে দিতে চায়। সে জন্য মিয়ানমারের সব আচরণে বাংলাদেশ সহিষুষ্ণতা প্রদর্শন করে আসছে।
অতীতে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হলেও দেশটি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। তারপরও মিয়ানমারকে সঠিক বার্তা দেওয়া জরুরি। সেদিক থেকে আমি মনে করি, বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া মিয়ানমার যখনই বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে, তখনই আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি। ২৮ আগস্টে মর্টার শেল নিক্ষেপের পরদিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করা হয়। নিকটতম প্রতিবেশী হিসেবে মিয়ানমারের এসব কর্মকাণ্ড যে বন্ধুত্বের নিদর্শন নয়- সেটি দেশটির রাষ্টদূতকে ডেকে কড়া ভাষায় জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশের এ ভাষা মিয়ানমারের বোঝা উচিত। সামরিক বাহিনীর বাড়াবাড়ির কারণে শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরেই নয়; তারা গোটা অঞ্চলের শান্তি বিনষ্ট করছে। এর পরও যদি তারা উস্কানি বন্ধ না করে; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক শক্তি নিশ্চয় দেশটির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত

পাঠকের মতামত

আসলে কি বয়কট করছি!

আমরা বাঙালি নতুন ইস্যু পেলে দৌড়ে তা দেখার জন্য উৎকণ্ঠা প্রকাশ করি। আজ বয়কট নিয়ে ...